কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে জোবাইদা নাসরীন ২০১৭ সালের পর থেকে নীলক্ষেত এলাকা মাঝে মাঝেই অবরোধে পড়ে। এখন অনেকটাই যেন মুক্ত হয়েছে। সবাই জেনে গেছে এখন ...
কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে
জোবাইদা নাসরীন
২০১৭ সালের পর থেকে নীলক্ষেত এলাকা মাঝে মাঝেই অবরোধে পড়ে। এখন অনেকটাই যেন মুক্ত হয়েছে। সবাই জেনে গেছে এখন নীলক্ষেতে অবরোধ হওয়া মানেই সাত কলেজের আন্দোলন। সম্ভবত সাত কলেজের দুটো কলেজ (ইডেন কলেজ ও ঢাকা কলেজ) নীলক্ষেতের কাছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা হওয়ায় আন্দোলনের ক্ষেত্রটি নীলক্ষেত মোড় হয়েছে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, এই কলেজগুলোতে শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্যই মূলত ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর সাতটি পুরনো এবং খ্যাতিসম্পন্ন সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর আগে এই সাতটি কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত হওয়ার আগে এগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই ছিল। এই কলেজগুলো হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।
বেশ আলোড়ন তৈরি করেই এই সাত কলেজ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, অধিভুক্তির শুরু থেকে নানা বিষয়ে আন্দোলন শুরু হয় সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের। প্রথমদিকে বিষয়টিকে সে সময়কার দুই ভিসির লড়াই হিসেবে দেখছিলেন অনেকেই। যতদূর মনে পড়ে ২০১৭ সালের ২০ জুলাই থেকেই এই আন্দোলনের সূচনা। সেই বছরেই নির্ধারিত সময়ে ফল প্রকাশ ও পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে প্রথম আন্দোলন শুরু করে ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত অনেক দূর গড়ায়। চোখ হারান তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর। কেননা আন্দোলন দমন করতে কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে পুলিশ এবং সেই গ্যাসের শেলে দৃষ্টিশক্তি চলে যায় সিদ্দিকুরের। সেখানেই থামেনি সেই আন্দোলনের রেশ। সেই আন্দোলনে এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ।
এর পর ২০১৯ সাল পর্যন্ত দফায় দফায় রাস্তায় নেমেছে এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের কর্মকর্তা এবং শিক্ষকরাও এই সাত কলেজ নিয়ে অনেকটাই চাপে রয়েছেন।
তবে এবারের আন্দোলনের দাবি সাতটি। এই দাবির মধ্যে মধ্যে রয়েছে যেসব শিক্ষার্থী পরবর্তী বর্ষের ক্লাস, ইনকোর্স ও টেস্ট পরীক্ষা পর্যন্ত অংশগ্রহণ করার পর জানতে পেরেছেন নন-প্রমোটেড তাদের মানোন্নয়ন পরীক্ষার মাধ্যমে পরবর্তী বর্ষের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ, নির্ধারিত সময়ের পর অর্থাৎ দেরিতে ফলাফল প্রকাশের কারণ ও এ সমস্যা সমাধানে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা, নব্বই দিনের মধ্যে পরীক্ষার ফল প্রকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার ভবনে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের হয়রানির কারণ এবং শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধ করা, একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাও এই দাবিগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর পাশাপাশি শিক্ষক ও ক্লাসরুম সংকট নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং সব বিষয়ে পাস করার পরও একজন শিক্ষার্থী সিজিপিএ শর্তের জন্য নন-প্রমোটেড হচ্ছেন সে কারণে সিজিপিএ’র এ শর্ত শিথিল করার দাবি জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা। তবে এই সাতটি দাবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অভিভাবক কে বা কারা? তারা আসলে কোথায় তাদের সমস্যাগুলো উপস্থাপন করবেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই আসলে বেশ কয়েকটি সমস্যা সমাধানের জন্য জরুরি। কারণ তাদের পড়াচ্ছেন তাদের নিজ নিজ কলেজের শিক্ষকরা, কিন্তু পরীক্ষা নিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সব ঠিক করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তা হলে তাদের মূল কর্তৃপক্ষ কারা? তাদের নিজ নিজ কলেজ কর্তৃপক্ষ নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? তারা সনদ পাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, এজন্য কি সব দাবি-দাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে? তা হলে তাদের কলেজ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা কী? তারা কী আন্দোলনের দাবি বা সমস্যা সমাধান করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বসছেন কিংবা তারা কী ধরনের ভূমিকা নেন? নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়েছে বলে কলেজগুলোর কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের দায় নেই?
এবারের আন্দোলনের এক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন থেকে সরে আসে এবং পরে আশ্বাসের কোনো ধরনের অগ্রগতি না হওয়ায় তারা ১৬ দিন পর আবারও নীলক্ষেত অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষার্থীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাদের দাবি না মানলে তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন। তবে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নিতে পুলিশ লাঠিপেটা করে। কারণ এই অবরোধের কারণে সেই এলাকায় তৈরি হয় বড় ধরনের যানজট।
এ তো গেল সাত কলেজের অবস্থা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গণরুম’ বিলুপ্তি, ‘মেয়াদোত্তীর্ণ’ শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে হলত্যাগ এবং ‘গণরুম’ ও ‘মিনি গণরুমে’ অবস্থান করা বৈধ শিক্ষার্থীদের ‘সিট’ নিশ্চিত করার দাবিতে তারা লড়ছে বেশ কয়েকদিন ধরেই। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি, এই দাবি শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি নয়, এটি সম্ভবত বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি। গত ত্রিশ বছরে বিভিন্ন সময়ে এই দাবি শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি হিসেবে উচ্চারিত হয়েছে এবং পোক্ত হয়েছে। কিন্তু এই দাবির প্রতি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই মনোযোগ দিতে পারেনি কিংবা দিতে চায়নি। এর কারণ কী? শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অধিকারের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো আবাস নিশ্চিত করা। কিন্তু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই কাজটি করতেই ব্যর্থ হচ্ছে। শুধু তাই নয়, যারা এই অধিকারের নিশ্চয়তার জন্য আন্দোলন করছেন তারা একা হয়ে পড়ছেন। কারণ তাদের ওপর নেমে আসছে নিপীড়ন। পাছে তার শিক্ষার অধিকারটুকু হারিয়ে না যায় এই ভয়ে অনেকেই আন্দোলন করতে ভয় পান। এর আগেও আমরা দেখেছি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জারি থাকা র্যাগিংয়ের কারণে অনেক শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু তাতেও বন্ধ হয়নি র্যাগিং। চলছেই।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সাত কলেজের দাবি-দাওয়াÑ সবকিছুর মূলেই রয়েছে আসলে কর্তৃপক্ষের অমনোযোগিতা। কেনই বা পর্যাপ্ত জনবল না থাকা সত্ত্বেও সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আনা হলো? কারা আসলে শিক্ষার্থীদের এই সমস্যা সমাধানের মূল কর্তৃপক্ষ? কর্তৃপক্ষ অনেক হলে সেখানেও তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। একে অপরের দিকে আঙুল তুললে কোনোভাবেই সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের মূল লক্ষ্য হতে হবে শিক্ষার্থীদের সমস্যার সমাধান।
আমাদের জানতে হবে কেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হচ্ছে? অবরোধ করতে হচ্ছে, কেন নীলক্ষেত মোড়ে তারা বারবার বসছে এবং দাবি তুলছে। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দিয়ে দেখলে সমস্যার সমাধান না হয়ে ভুল বোঝাবুঝির জায়গাই বাড়ে। তাই কলেজগুলো এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একসঙ্গে বসেই এই সমস্যাগুলোর সঠিক সমাধান দিতে হবে। বুঝতে হবে দাবি মানার মানে হেরে যাওয়া নয়, এটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ।
আরেকটি বিষয় এখানে খোলাসা করা দরকার। এই সাতটি দাবির কয়েকটি গত ছয় বছর ধরেই করছে, কিন্তু এখনো সেগুলোকে আমলে নেওয়া হয়নি। তাই সমস্যাগুলো এখন আরও জটিল হয়েছে।
পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয়েই হয়তো শিক্ষার্থীরা তাদের ঢংয়ে আন্দোলন করে, দাবি-দাওয়া উত্থাপন করে। কিন্তু আমরা সমস্যাগুলোকে নিয়ে চিন্তিত হই না, কারণ আমাদের ভয় অন্য জায়গায়।
ড. জোবাইদা নাসরীন : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
COMMENTS