রাজনীতিতে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা-এমনটা বলা যায় না। তবে কে না জানে, ধীরে হলেও পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে। মাঠ এখন পর্যন্ত শান্ত। যেন চূড়ান্ত লড়াই...
রাজনীতিতে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা-এমনটা বলা যায় না। তবে কে না জানে, ধীরে হলেও পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে। মাঠ এখন পর্যন্ত শান্ত। যেন চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই শিবিরই। পর্দার আড়ালে দৌড়ঝাঁপ চলছে। ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কূটনীতিকরা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের কথায় স্পষ্ট, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ওয়াশিংটনের সহযোগিতা চেয়েছে ঢাকা। এই যখন অবস্থা তখন দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন মো. সাহাবুদ্দিন। গতকাল সকালে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী তাকে শপথ পড়ান। এমনিতে সংবিধানে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত।
তবুও কখনো কখনো বঙ্গভবনের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, বিশেষত নির্বাচনকালীন সময়ে। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এরইমধ্যে নির্বাচন নিয়ে মুখ খুলেছেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক। বাংলাদেশের রাজনীতি চলছে পুরনো ছকে। দুই পক্ষই অটল এবং অনড়। এক পক্ষের সাফ কথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবেন না।
গত দুটি নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে বিএনপি এবং সমমনাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। অন্যদিকে, শাসক দলের দাবি, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে এটাও বলা হচ্ছে, নির্বাচন হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গত কয়েক মাস ধরেই বিএনপি নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে আসছে। সভা-সমাবেশ-মানববন্ধনের মতো কর্মসূচিতেই প্রাধান্য দিয়েছে দলটি। সমমনা অন্যান্য দলও শরিক হয়েছে যুগপৎ আন্দোলনে। এই আন্দোলন সরকারের ওপর খুব একটা চাপ তৈরি করতে পেরেছে- এমনটা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন না। বিএনপি’র সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনের আর বেশি সময় নেই। তাই সহসাই আন্দোলনে গতি আনতে চায় দলটি। অন্যদিকে, বিএনপি’র এই দফার আন্দোলনের শুরু থেকেই মাঠে সক্রিয় আওয়ামী লীগ। নানা কর্মসূচি পালন করছে দলটি। এই পরিস্থিতিতে রাজনীতি কোনদিকে মোড় নিচ্ছে সেই আলোচনা ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরাশক্তিগুলোর বরাবরই বড় ভূমিকা রয়েছে।
সম্প্রতি বিএনপি’র এক সিনিয়র নেতা এ রিপোর্টারকে বলেন, ‘এটা স্বীকার করা হোক বা না হোক সত্য হচ্ছে একটি বড় দেশের সমর্থন না থাকলে বর্তমান সরকারের শাসনকাল এত দীর্ঘায়িত হতো না।’ বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনেও বড় দেশগুলোর ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। যদিও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য ইস্যুর মতো এ ইস্যুতেও বিভক্তি স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো রয়েছে একই ভূমিকায়। তারা বাংলাদেশে একটি অবাধ, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক না হলে সে নির্বাচন গ্রহণ করা হবে না বলেও তাদের পক্ষ থেকে বার্তা রয়েছে। অন্যদিকে, চীন ও রাশিয়া মনে করে নির্বাচনের মতো ইস্যুগুলো বাংলাদেশের নিজস্ব। অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে অন্যদের ভূমিকা না রাখার কথা বলছেন তারা। ভারতের পক্ষ থেকে নতুন করে কিছু বলা হয়নি। তবে দেশটির ভূমিকা সবারই জানা। মাঠের আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর ভূমিকা ঘিরে নির্বাচনকালীন সময়ে প্রেসিডেন্টের ভূমিকা কী হতে পারে রাজনীতির অন্দরমহলে এ নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। অতীতে এমন গুঞ্জনও তৈরি হয়েছিল, হয়তো প্রেসিডেন্টকে বিশেষ কিছু ক্ষমতা দেয়া হতে পারে। কখনো কখনো তার আরও বড় ভূমিকার কথাও শোনা যায়। তবে বিএনপি’র সূত্রগুলো বলছে, প্রেসিডেন্টের বিশেষ ভূমিকায় নির্বাচনী রাজনীতির জট খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন প্রেসিডেন্ট গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত নন।
মির্জা ফখরুল মানবজমিনকে বলেন, বর্তমানে যারা দেশ পরিচালনা করছেন তারা অনির্বাচিত। তারা অগণতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করেছেন। এই যখন অবস্থা তখন ভোটে প্রেসিডেন্টের ভূমিকা কী? সম্প্রতি ঢাকার একটি দৈনিকের কাছেও নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলেন মো. সাহাবুদ্দিন। এতে তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি মনে করেন, ভোটকেন্দ্রে জনগণের যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সেই দায়িত্ব সূচারুভাবে পালনের জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি তার আহ্বান থাকবে। তার নিজের পক্ষ থেকে সংলাপের কোনো উদ্যোগ থাকবে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখবেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার করণীয় কিছু থাকলে তিনি তা করবেন।’ আইনবিদরা বলছেন, সংবিধানে প্রেসিডেন্টকে নির্বাচনের ব্যাপারে বিশেষ কোনো ক্ষমতা দেয়া হয়নি। তবে নির্বাচনের ব্যাপারে আইন বা সংবিধানের ভূমিকা মুখ্য নয়। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সমঝোতার গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক মনে করেন জাতীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করা যায়। আমাদের এখানে অতীতে রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এরশাদ সাহেবের পতনের পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হলেন সেটাতো সংবিধানে ছিল না। এমনকি পরে তিনি আবার প্রধান বিচারপতি পদেও ফিরে গেলেন। পুরো বিষয়টি পরে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে জায়েজ করা হয়।’
আইনের শিক্ষক ড. মালিক আরও বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে তখন তা সংবিধানে ছিল না। রাজনৈতিক সমঝোতা এবং চাপের মুখে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয়। তখনো সংবিধানে সংশোধন আনা হয়। এবারও রাজনৈতিক সমঝোতা হলে তত্ত্বাবধায়ক ফেরাতে কোনো বাধা নেই। তবে শাহদীন মালিক এ প্রসঙ্গে একমত পোষণ করেন যে, বর্তমান সংবিধানের আওতায় প্রেসিডেন্টের বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রেও সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হবে।
সাহাবুদ্দিনের শপথ
বাংলাদেশের ২২তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন মো. সাহাবুদ্দিন। গতকাল সকালে বঙ্গভবনে নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানটি ছিল মিনিট দশেকের। এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যসহ কয়েকশ’ অতিথি উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। নতুন রাষ্ট্রপতি শপথ নথিতে স্বাক্ষর করেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মো. সাহাবুদ্দিন। শপথ গ্রহণের পর নতুন প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানান প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ। চেয়ার বদলের মাধ্যমে দায়িত্ব হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন করেন তারা। দরবার হলে শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয় কোরআন তেলাওয়াতের মধ্যদিয়ে। শপথ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ছাড়াও সংসদ সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, তিন বাহিনী প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, সাংবাদিক, সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের জন্ম ১৯৪৯ সালে পাবনা শহরের জুবিলি ট্যাঙ্কপাড়ায়। ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাসের পর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়ে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২ সালে) বিএসসি পাস করেন মো. সাহাবুদ্দিন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ও পাবনা শহীদ এডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি পান। ছাত্রলীগে যুক্ত হওয়ার পর এডওয়ার্ড কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক, অবিভক্ত পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি থেকে ছয় বছর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন মো. সাহাবুদ্দিন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) পরীক্ষা দিয়ে তিনি বিচারক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে পর পর দুইবার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন তিনি। বিচারালয়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন শেষে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে ২০০৬ সালে অবসরে যান মো. সাহাবুদ্দিন। শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান পদেও তিনি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন মন্ত্রণালয়ের নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অবসরের পর আইন পেশায় ফেরেন মো. সাহাবুদ্দিন। পরে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
COMMENTS